মাগুরা থেকে-মোহাম্মদ ইউনুস আলী
শুভ মানস গড়ার তাগিদ প্রকাশে লেখক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়ার নতুন বই ‘সুখ-সাফল্যের পথ নকশা’। সুখ-সাফল্যের সিরিজে তাঁর আগের প্রয়াস ‘সাফল্যের অদৃশ্য সিঁড়ি’ ও ‘সুখ-সাফল্যের মায়াবী জগৎ’ বইগুলো পড়ার ও আলোচনার সুযোগ পাবার পর সত্যি বলতে কি একটা পিপাসা জেগেছিল। হয়তো পাঠকেরও তা-ই। সেই তৃষ্ণা নিবারণে এল তৃতীয় এ বইটি।
আমরা যারা বয়সের কারণে এদেশের বর্তমান ও সম্ভাবনাময় তারুণ্যের বিকাশ নিয়ে হতাশাক্রান্ত, তাদের জন্য আশার সঞ্চার করবে এই উদ্যোগ। ‘সাফল্যের অদৃশ্য সিঁড়ি’ ও ‘সুখ-সাফল্যের মায়াবী জগৎ’ বইগুলোকে আমি আর দশটা সাধারণ লেখার মতো নিতে পারিনি। এটাকেও পারব না। কারণ একটাই, যে দেশে নীতি-নৈতিকতা এবং মানসিক শুভ শক্তি ও সামর্থ্যরে অভাব ভাত-কাপড়ের অভাবের চেয়েও প্রকট, সেই লোকসমাজে মানুষের উন্নত মানস গঠনের অনুশীলন যে কতটা প্রাসঙ্গিক ও জরুরি তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার হয় না। চয়ন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সুখ-সফল্যের পথ নকশা’ বইটি নৈতিকতানির্ভর উন্নত মানস গঠনের সত্যিই এক মহিমাময় পথ-নির্দেশ। লেখক যথার্থই অনুধাবন করেছেন, এদেশের তরুণ-যুব সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন সুনীতি, সততা, ও আত্মশক্তির উদ্বোধন আর সেই আত্মশক্তির জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস।
আত্মবিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা কতকটা বারুদের মতো। নিজ আয়ত্তে সে দাহ্য হয়ে আগুন জ্বালানো শুরু করে। তারপর সে আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। আত্মবিশ্বাস মানসিক শক্তির বিষয়; একবার সে জ্বলে উঠলে সমষ্টি এবং পারিপার্শ্বিকতায় এর প্রভাব পড়বেই। অর্থাৎ ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে রূপান্তরিত হতে পারে আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় আত্মমর্যাদাবোধ। ইতিবাচক চিন্তা, আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের ত্রুটি শনাক্ত করা, অন্যের আচরণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে গ্রহণ করা, উত্তেজনা ও উৎক্রান্তিকতা প্রশমন করা, নিজের সুপ্ত গুণাবলিকে গঠনশীল ও ইতিবাচক কাজে প্রবাহিত করা—এগুলো আসলেই মানসিক শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করা ও তাকে সংহত করার উত্তম বিহিত। এ কথাটি লেখকের সব কয়টি স্তবকের মূল প্রতিপাদ্য। এই মানোবাস্তবতাগুলোকেই ছোট ছোট অধ্যায়-উপাধ্যায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন লেখক। ‘সুখ সাফল্যের পথ নকশা’ শিরোনামটি আসলেই এই প্রকাশনার শীর্ষসূচক হিসেবে যথার্থ হয়েছে। এই উপদেশাবলি আসলেই উন্নত মানস এবং উচ্চ আত্মবিশ্বাস অর্জনের পথ নির্দেশকস্বরূপ। এখানেই শেষ নয়, লেখক তার সম্ভারকে এক অনুপম বৈশিষ্ট্য দান করেছেন জাগতিক উন্নতির সাথে নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধের তাগিদকে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে। মানসিক শক্তি সঞ্চয় ও সংহত করে জাগতিক সাফল্যের লক্ষ্যে বহু লেখক, বহু মাধ্যমে, বহু ভাষায়, বহু জনগোষ্ঠীর জন্য লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন। সেগুলো ব্যক্তির পার্থিব কল্যাণের জন্য অবশ্যই হিতকরী এবং ফলদায়ক। তবে ওই যে কথাটি, Man does not live by bread alone (মানুষ কেবল খাওয়ার জন্যই বাঁচে না), এ কথাটি তো সর্বকালের সর্বজনের জন্যই প্রযোজ্য।
সুখ-সাফল্যের পথ নকশা’য় স্থান পেয়েছে উপদেশাশ্রয়ী ৭৯টি স্তবকের এক দীর্ঘ বিন্যাস। আলোচনাগুলি নিজ নিজ অধ্যায়ে সংক্ষেপে লেখার ফলে ব্যস্ত সময়ের ব্যস্ত বা ব্যতিব্যস্ত পাঠকের বেশ সুবিধা হবে। প্রতিটি স্তবকে রয়েছে আলোচ্য বিষয় নিয়ে নানা যুগের নানা মতের মনীষীদের জুতসই উদ্ধৃতি। বইটি পড়ে মনে হবে মানবীয় গুণাবলি এবং সংশয়-সংকট ও চিন্তার দারিদ্র্যের এই কঠিন সময়ে প্রসঙ্গগুলো সবার জীবনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত বা প্রাসঙ্গিক। যেন উন্নত মানস গড়ার এক পথনির্দেশক তার পথ নির্দেশ এবং উপায়ান্তরের এক পাঠ্য ভাণ্ডার খুলেছেন তিনি। এ যেন লেখকের অনুভব এবং হিতাকাঙ্ক্ষার এক সমৃদ্ধ ‘মোহাফেজখানা।’ সীমাবদ্ধতা যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তৈরি-চিত্রকল্পের যেখানে অভাব নেই, সেখানে প্রসঙ্গ অনুযায়ী কিছু দৃশ্যপট বা ‘ইমেজারি’ বা একান্ত Relief-এর জন্য হলেও আনলে ভালো হতো। ভালো হতো, বইটির মূল্যও সাধারণ পাঠকের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য আরেকটু কমাতে পারলে। তবে যে উদ্যোগ অমূল্য, গ্রন্থমূল্যের কৈফিয়ত সেখানে অপ্রাসঙ্গিক, এটাও মানতে হবে। এ তো আর বাণিজ্যিক ‘পেপারব্যাক’ বা মামুলি কোনো ‘ফিকশন’ নয়! লেখকের ভাবনা-গণ্ডি ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। তিনি ব্যক্তির মানস উন্নত করে তাকে সমষ্টির কল্যাণে অর্থাৎ পরিবেষ্টনীর মঙ্গলে নিবেদন করার তাগিদ রেখেছেন প্রতিটি অধ্যায়ে। জীবনের সঠিক অর্থ অনুধাবন এবং সার্থকতা অনুসন্ধানের পেছনে যে মহৎ মানবীয় আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে থাকে, তাকে তিনি উন্মুক্ত করেছেন তার এই উদ্ধৃতিবহুল এবং মানবকল্যাণের লক্ষ্যে উৎসর্গিত গ্রন্থটিতে।
সবশেষে, কতকটা লেখকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই, আর দুইটি উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। প্রথমটি কামিনী রায়ের। দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের। ‘করিতে পারি না কাজ/সদা ভয় সদা লাজ/সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/পাছে লোকে কিছু বলে… মহৎ উদ্দেশ্য যবে/এক সাথে মিলে সবে/পারি না মিলিতে সেই দলে/পাছে লোকে কিছু বলে…।’ অন্যটি হলো, ‘সত্য ঢাকা পড়ে মোর ভয় ভাবনায়/মিথ্যার মুরতি গড়ি ব্যর্থ বেদনায়।/বিশ্ব আনন্দের সৃষ্টি, আনন্দেই ভরা/মোর সৃষ্টি মায়া দিয়ে স্বপ্ন দিয়ে গড়া।’
এই যে সংশয়-দ্বিধার জন্য কিছু করতে না পারা; কিংবা প্রকাশের সৎ সাহসের অভাবে মিথ্যার কাছে সত্যের পরাজয়ের গ্লানি, এ থেকে বের হয়ে সহজ, সরল, সৎ, সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী মানস গঠনের তাগিদ লেখক ও সমাজ গবেষক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া তার ‘সুখ-সাফল্যের পথ নকশা’ বইটিতে প্রকাশ করেছেন, বর্তমান প্রজন্মের মানুষের সংশয়ী ও অলস মানস প্রকৃতিকে জাগাতে, বদলাতে এবং আদর্শ রূপ দিতে তথা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সহায়ক হবে। আমি বইটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা এবং লেখকের প্রশংসনীয় মিশনের সার্বিক সাফল্যের আশা রাখছি।
লেখক পরিচিতি
আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্ট।