মিরু হাসান বাপ্পী
আদমদিঘী (বগুড়া) প্রতিনিধিঃ
সান্তাহার রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘদিন ধরে থাকছে ১৫ বছরের কিশোর হাসান (ছদ্মনাম)। তাহ পার্টি আর ও জন রয়েছেন পিতামাতাহীন ভবঘুরে জীবনযাপন তাদের। কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিক, লোহা কিংবা পুরনো জিনিস বিক্রি করে এবং সন্ধ্যায় পর ভিক্ষা করে পেট চালায় তারা। ঘাড়ে চটের বস্তা নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে বেড়ায় হাসান ও তার হসপার্টিরা সারাদিনের সংগৃহীত ভাঙারি বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে একবেলা খাবার কিনে খায়, আর বাকি দুই বেলা নেশা করে তারা। নেশার এই উপকরণটির নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট আঠা, তবে ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত।
ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামক আঠালো বস্তুটি (গাম) দিয়ে নেশা করে হাসানের মতো অসংখ্য পথশিশু-কিশোর। টলুইন সমৃদ্ধ এই অ্যাডহেসিভ মূলত ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া ও প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। মূলত ‘ড্যান্ডি’ আঠা ঘ্রাণযুক্ত এবং ঘ্রাণ থেকেই এক ধরনের আসক্তি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে তৈরি ড্যান্ড্রাইট অ্যাডহেসিভ টিউবে এবং কৌটায় দু’ভাবে পাওয়া যায়। প্রতিটি টিউবের দাম ১৫০-২০০ টাকা, কৌটার দাম ৩৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। এগুলো সাধারণত হার্ডওয়ারের দোকানে বিক্রি হয়। দাম বেশি হওয়ায় আসক্ত শিশুরা কৌটা কিংবা টিউব কেনে না। তারা যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক রিপেয়ারের দোকান বা জুতা মেরামতকারীদের (মুচি) কাছ থেকে ২০-৩০ টাকার বিনিময়ে অল্প করে সংগ্রহ করে থাকে।
হাসানের মতে, প্রথম প্রথম ঘ্রাণটা ভালো না লাগলেও পরে ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। একবার ড্যান্ডির ঘ্রাণ নিলে সারাদিন মাথা ঝিম ঝিম করে, কারও কথা মনে পড়ে না।
সান্তাহার রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এলাকা ঘুরে হাসানের মতো আরও পথশিশুদের এভাবেই নেশা করতে দেখা যায়। পথশিশুদের কেউ কেউ দিনের বেলা নেশা করলেও বেশিরভাগই নেশা করে রাতে। কেউ একা, আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে সংঘবদ্ধ হয়ে নেশা করে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও নিজের পরিধেয় জামায় ড্যান্ডি গাম লাগিয়ে নেশা করে তারা। কিছুক্ষণ পর পর ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় বুদ হয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, বগুড়া থেকে সান্তাহার শহরে কমপক্ষে ২৫-৩০ টি স্পট রয়েছে। এসব জায়গায় ৯ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে এবং পেট্রোল শুঁকে নেশা করে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালানো হয়। দেশের সাতটি বিভাগে সাত বছরের ওপরে ১৯ হাজার ৬৬২ জনের ওপর মাদক ব্যবহারের প্রকোপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের ওপর সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. ফারুক আলমের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বছরব্যাপী পরিচালিত এই সমীক্ষার তত্ত্বাবধান করেন।
মাদক সেবনকারীদের ওপর ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের ওপরে বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। এর মধ্যে মারাত্মক অবসাদে আক্রান্ত হয় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, রোগ নিয়ে চিন্তায় থাকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, সব সময় চিন্তাগ্রস্ত থাকে ২ শতাংশ, সিজোফ্রেনিয়ায় শূন্য দশমি ৮ তাংশ আক্রান্ত থাকে। মাদক সেবনের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া, রাতের বেলা বিছানায় প্রস্রাব করার মতো বিভিন্ন মানসিক রোগের প্রকোপ থাকে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে মাদকাসক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে— কৌতূহল, অসৎ সঙ্গ, মাদকের সহজলভ্যতা, অভিভাবকদের নজরদারির অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ সন্তান প্রতিপালনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে করা এই গবেষণায় পথশিশুদের বিষয়টি কম এসেছে। আমরা সবেচেয়ে বেশি গাঁজা সেবনকারী পেয়েছি, এরপর অ্যালকোহল, তারপর পেয়েছি ইয়াবা সেবনকারী। কেবল যদি পথশিশুদের মধ্যে জরিপটি করতাম, তাহলে উল্লেখযোগ্যভাবে এই ড্যান্ডি ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তথ্য পেতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা নাক দিয়ে এই অ্যাডহেসিভ-এর ঘ্রাণ নিয়ে নেশা করে। কারণ, এর ভেতরে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ থাকে। এটা মস্তিষ্কে গিয়ে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ফলে তাদের ভেতরে এক ধরনের সুখের অনুভূতি তৈরি হয়। এই অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। এই অ্যাডহেসিভের ঘ্রাণ শরীরের যেসব জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, সেসব জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আর কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কাজে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এছাড়াও, নাকের ভেতরে ঘা হয়ে যায়। এ ধরনের মাদকে শারীরিক এবং মানসিক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। শিশুরা যেহেতু এটা গ্রহণ করে, ফলে এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ।’
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সমস্যা রাতারাতি বন্ধ হবে না। এর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (লিডো) নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছি। রাস্তা থেকে শুরু করে একেবারে হোম (আশ্রয়কেন্দ্র) পর্যন্ত বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করি। আমি মনে করি, নেশাগ্রস্ত পথশিশুদের একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রথমে তাদের জন্য পথে শিক্ষার ব্যবস্থা করি, সেখান থেকে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসি। এখানে আনার পর তাদের পরিবারের খোঁজ করি, না পেলে আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে তাদেরকে নেশাগ্রস্ত জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসি।’
প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই শিশুদেরকে নেশার জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ কিছু করা যাবে না।